[এটি একটি কাল্পনিক গল্প। যদিও গল্পের সব চরিত্র, কাহিনী এবং স্থান কল্পিত, তবে শহর এবং গ্রামে তাদের বাস; তাদের নিরাপদ পানি প্রাপ্তির সুযোগ এবং অসুস্থতার বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটগুলো বাস্তব। গল্পের কাহিনী, টাইফয়েড জ্বর এবং টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) থেকে উপকার পেতে পারে এমন শিশু এবং তাদের পরিবারের কাহিনী বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে রচিত। ]
কারখানায় কাজ শেষ করতে নাজমার আজও দেরি হয়ে গেছে।
নাজমা কারখানার গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমেই আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ অন্ধকার। মনে হচ্ছে রাত আটটার বেশি বাজে। যদিও তার বের হওয়ার কথা ছিল বিকাল পাঁচটায়। বাসায় যেতে যেতে রাত নয়টা। মে মাসের গরমের রাত। কয়েক মাইল হেঁটে শহরের বাসায় ফিরেই কল থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নেয়। যদিও পানিটা তার ফুঁটিয়ে খাওয়াও উচিত ছিল, কিন্তু এখন সে খুব তৃষ্ণার্ত। গন্ধওয়ালা পানিতে কেমন যেন টক টক স্বাদ। কে জানে, নর্দমার ভেতর দিয়ে যাওয়া পানির লাইন বোধ হয় কোথাও ফেঁটে গেছে। লাইনের পানিতে ঢুকছে মল আর আবর্জনা। প্রায় সময়ই তা হয়।
আসার সময় দুটো ডিম কিনে এনেছিলো। সেগুলোই ভুনা করে তরকারি করলো। তার স্বামী মতি এখনও কাজ থেকে ফেরেনি। তার ফেরার কথা রাত দশটায়। নাজমা গ্রামে থাকা তার শাশুড়িকে মোবাইলে ফোন দিলো।
হ্যালো আম্মা। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?
হ্যালো, না রে। ঘুমাই নাই। তোর ছোট্টটার বিকাল থেকে জ্বর।
নাজমার দুই মেয়ে। দুইজনেই দাদীর সাথে গ্রামে থাকে। ছোটটার বয়স চার আর বড়টার বয়স ছয় বছর। বড়টা কিছুদিন হল স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। শহরে থেকে খরচে পোষায় না বলে বাচ্চাদের নিজেদের কাছে এনে রাখা হয় না।
ও কি ঘুমাচ্ছে?
হু ঘুমাচ্ছে। তোমরা আসবা কবে? ছুটির তো অনেক দেরি। এইদিকে হাতে টাকা-পয়সাও নাই। বড়টা স্কুলে যায়। বাইরের এটা সেটা খেতে চায়। দিতে পারি না।
বাইরের খাবার খাওয়াবেন না আম্মা। ওদের ছোট খালার কথা মনে করুন। বাচ্চা বয়সে মারা গেলো মেয়েটা টাইফয়েড জ্বরে। সবাই সন্দেহ করল রাস্তার দূষিত খাবারের কারণে তা হয়েছিল। ওদের বাবারও কয়েকদিন ধরে অনেক জ্বর আসে। পেটের পীড়া হয়। আমাদের ঘরে কলের পানিতে গন্ধ করে। সন্দেহ হয় পানিতে দূষণ ছড়াচ্ছে।
মতি কি বাসায়?
না আম্মা ও এখনও কাজ থেকে ফিরে নাই। ও আসলে আমি বলব মেয়েকে ডাক্তার দেখানো জন্য আপনাকে টাকা পাঠাতে। দুপুরে ওকে স্কুলের টিফিনে রাস্তার দূষিত খাবার কিনে দেবেন না, বরং ঘরে তৈরী খাবার দেবেন।
নাজমা মোবাইল ফোন রাখল।
তাদের পাশের ঘরে হাই স্কুলে পড়ুয়া তিন বোন থাকে। এরা সারাদিনই ঘরের বাইরে- হয় স্কুলে না হয় কোচিং ক্লাসে থাকে। বাইরে বাইরেই খাওয়াদাওয়া করে। প্রায়ই ওরা অসুস্থ থাকে। কয়েক মাস আগে বড় মেয়েটি টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলো। টাইফয়েড জ্বর যে কি কঠিন জিনিস নাজমা তখনই বুঝলো! পাক্কা দুই মাস অ্যান্টিবাযোটিক ঔষধ খেয়েছে মেয়েটা। দূর্বল থাকায় স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার আগে বাড়িতে বাবা-মার কাছেও যেতে পারে নাই। এখন সে পরীক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু ভীষণ রোগা হয়ে গেছে। নাজমা গেল ওদের ঘরে গল্প করতে।
আজ তোমরা কি রান্না করছো?
মেঝো মেয়েটা বলল। আজ শাক ভাজি আর ডাল রান্না করছি। কিন্তু খাব কি? কলের পানিতে যে গন্ধ!
হ্যাঁ, আমিও কলের পানিতে গন্ধ পাচ্ছি। আজ আমার স্বামী আসলে বলব একটা পানির ফিল্টার কেনার জন্য। আমরা দুই ঘরের মানুষ একত্রে ব্যবহার করব পানির ফিল্টারটা। তোমরাও পানি খাবে। টাইফয়েড থেকে তুমি সবেমাত্র সেরে উঠেছো। তোমরা প্রায়ই অসুস্থ থাকো।
জানেন আপা, সরকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টাইফয়েডের নতুন এক টিকা─ নাম টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন বা টিভিসি দেবার পরিকল্পনা করেছে। নবম শ্রেণী পর্যন্ত সবাইকে বিনামূল্যে টিকা দেবে। শুধুমাত্র জন্ম সনদ দেখালেই হবে।
নাজমা ওদের জিজ্ঞাস করে গ্রামে থাকা তার মেয়েরাও টাইফয়েডের এই নতুন টিকা নিতে পারবে কিনা।
হ্যাঁ আপা। সরকার নয় মাস থেকে পনের বছর বয়স পর্যন্ত সব শিশুদের বিনামূল্যে টিসিভি দেবে। গ্রামে শহরের সব জায়গায়। আমরা স্কুল থেকে টিকা নেব। কিন্তু ছোট বাচ্চারা পাড়ার স্থায়ী-অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্র থেকে টিকা পাবে।
নাজমা ঘরে এসে দেখে ওর স্বামী কাজ থেকে ফিরেই শুয়ে পড়েছে। ভীষণ জ্বর! রাতে কিছু খাবে না। নাজমা ভাবলেন তার স্বামীরও কি টাইফয়েড হতে পারে? সে তো টাইফয়েডের পরীক্ষা করায় নাই! ঔষধের দোকান থেকে অ্যান্টিবাযোটিক ঔষধ কিনে খাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। কিছুদিন ঔষধ খেয়ে ভাল হয়ে যায়। আবার মাসখানিক পর জ্বর ফিরে আসে।
ঘরের কাজ সেরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে নাজমার আবার নতুন টাইফয়েডের টিকার কথা মনে হলো। গ্রামে বাস করা তার ছোট্ট শ্যালিকা মারা যায় টাইফয়েড জ্বরে। তখন কেউ বুঝে উঠতে পারেনি ওর কি অসুখ হয়েছিল। এখন টিসিভি তার সন্তানদের রক্ষা করতে পারে।
রাত এগারোটা বাজে। এখন গ্রামে তার শাশুড়িকে মোবাইলে ফোন করার মত সঠিক সময় না। কিন্তু আগামীকাল ভোরের জন্য নাজমা আর অপেক্ষা করতে পারছে না। টিসিভি টিকাদান শুরু হবার আগেই তার শাশুড়িকে বলতে হবে যেন তাদের দুই মেয়েকেই নিকটস্থ ইপিআই টিকাদান কেন্দ্র থেকে নতুন এই টাইফয়েডের টিকা দেওয়া হয়। নাজমা টাইফয়েডের নতুন এই নিরাপদ ও কার্যকরী টিকার কথা সবাইকে বলতে চায়। সবারই জানা দরকার যে টিসিভি টিকাদান খুব শীগ্রই শুরু হবে। নতুন এই টিকা শিশুদের টাইফয়েড থেকে রক্ষা করবে।
পরের দিন সকালে নাজমা তার শাশুড়িকে ফোন করে। মোবাইলে রিং হচ্ছে। তার শাশুড়ি এখনও ফোন ধরছেন না। নাজমা তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে। তার দেরি সহ্য হচ্ছে না। সে তার সন্তানদের টাইফয়েড জ্বর থেকে রক্ষা করতে চায়।